শ্রীকৃষ্ণ ভগবান । রাধারাণী হচ্ছেন মূর্তিমতী ভক্তি । সখীবৃন্দ হচ্ছেন রাধারাণীর বিস্তার বা কায়ব্যূহ । মূর্তিমতী ভক্তির মাধ্যমে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধি করা সম্ভব হয় । শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যদি কেউ আমাকে জানতে চায় তবে তাকে অবশ্য ভক্তির আশ্রয়ে থাকতে হবে । ভক্ত্যা মাম্ অভিজানাতি । হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্রে প্রথমেই ‘হরে’ কথাটি বলতে ‘হে রাধারাণী’ বা ‘হে শ্রীকৃষ্ণের আনন্দদায়িনী’ বা হরা শক্তিকে বোঝায় । অভিমানী ব্যাক্তিরা আগে কৃষ্ণকে ভগবান মনে করে আর নিজেকে ভক্ত মনে করে । কিন্তু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শিখিয়েছেন যারা কৃষ্ণের সেবা করছেন সর্বক্ষণ সর্বভাবে তাঁদের দাসানুদাস শ্রীহতে । তাই সেই নিত্য সেবাভাব পরিস্ফুট করবার জন্য শ্রীকৃষ্ণের চতুস্পার্শে তাঁর সেবাপরায়ণা শক্তি সমূহ বিরাজ করছেন । তাছাড়া কৃষ্ণ কখনও একাকী থাকতে চান না, সর্বদা তাঁর সঙ্গে কেউ না কেউ থাকবেনই । অতএব সেইভাবে শ্রীকৃষ্ণ উপাসনাই পূর্ণ ও যথার্থ বলে স্বীকার্য ।
রাধারাণী বিবাহিতা হয়েও কৃষ্ণকে আবার কিভাবে বিবাহ করলেন ?
লহ্মীদেবী যেমন নারায়ণের নিত্যশক্তি । কখনও লহ্মীদেবীকে বিবাহ করে নারায়ণ পত্নীত্বে বরণ করেছিলেন-এমন নয় । তারা চিরকাল নিত্য পতি পত্নী রূপেই বিরাজমান । তেমনই গোলোকে শ্রীরাধারাণী ও শ্রীকৃষ্ণ নিত্য দম্পতিরূপে বিরাজমান । কিন্তু ভৌম ব্রজলীলায় রাধারাণীর সঙ্গে অভিমন্যু বা আয়ান ঘোষের যে বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল তা বিশেষ লীলারস আস্বাদন করার জন্য ভগবানের যোগমায়া শক্তির অঘটন-ঘটন পটীয়সী ব্যবস্থাপনা মাত্র । ভগবান শ্রীহরিকে দর্শনের জন্য অভিমন্যু পূর্ব জীবনে কঠোর তপস্যায় ব্রতী হয়েছিলেন । তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান শ্রীহরি তাঁকে দর্শন দিয়েছিলেন এবং প্রশ্ন করেছিলেন, “তুমি কি বর চাও ? যখন তপস্বী বলেছিলেন, “হে ভগবান ! আপনি আমাকে কি দিতে পারেন ?” শ্রীহরি বলেছিলেন, “তুমি যা চাইবে তাই দেবো ।” শ্রীহরির এই বাক্যের সততাকে পরীক্ষা করবার জন্য তপস্বী বলেছিলেন, “আমি চাই লহ্মীদেবীকে পত্নীরূপে লাভ করতে ।”
তপস্বীর এই রকম অদ্ভূত বর শুনে পরমেশ্বর শ্রীহরি বলেছিলেন, “হে তপস্বী ! তুমি যখন দ্বাপরে জটিলার পুত্ররূপে জন্মগ্রহন করবে তখন তোমার বাসনা পূর্ণ হবে, কিন্তু কখনও তুমি লহ্মীকে স্পর্শ করতে পারবে না ।” এই বলে শ্রীহরি অদৃশ্য হলেন ।
পরবর্তীতে সেই তপস্বী জটিলাদেবীর পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেন । কিন্তু বিবাহ লগ্নে তাঁর বুদ্ধিভ্রম হয় । তিনি দর্শকের মতোই বসে থাকেন । রাধারানী শ্রীকৃষ্ণের কাছে বহু মিনতি করেছিলেন যাতে শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া তার বরণ মালা কেউ যেন গ্রহণ না করে । ঘটনা ক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণই বিবাহ বেদীতে রাধারাণীর মালা গ্রহণ করেছিলেন । কিন্তু উপস্থিত জনতার কাছে শ্রীকৃষ্ণ অভিমন্যু রূপেই প্রতিভাত হন । যেভাবে মথুরায় কংসযুদ্ধে তিনি বিভিন্নরূপে প্রতিভাত হয়েছিলেন ।
শ্রীকৃষ্ণ কাউকেই বিরক্ত করতে চাননি । কিন্তু লীলার খাতিরে পূর্বে রাধারাণী অভিশপ্ত হয়েছিলেন যে, শতবর্ষ তাকে কৃষ্ণবিরহে থাকতে হবে । তাই অভিমন্যুর ঘরেই শ্রীমতী রাধারাণী গৃহিণীমাত্র হয়ে দিন অতিবাহিত করে সর্বক্ষণ শ্রীকৃষ্ণ চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন । এটিই ছিল অভিমন্যুর পূর্বজীবনের তপস্যার ফল স্বরূপ । প্রকৃতপক্ষে শ্রীরাধারাণীর বিবাহ শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গেই হয়েছিল, অভিমন্যুর সঙ্গে কদাপি নয় ।
রাসলীলার নামে পুরুষ-মহিলার নৃত্যকীর্তনের যৌক্তিকতা কি ?
রাসলীলা কখনই অনুকরণীয় নয় । প্রজাপতি ব্রহ্মা, মহাদেব শিব, স্বর্গরাজ ইন্দ্র, সমস্ত দেব-দেবী, গন্ধর্ব, অপ্সরা-কারও পক্ষে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর হ্লাদিনী শক্তি শ্রীরাধারাণীর রাসলীলা অনুপ্রবেশ বা অনুকরনের যোগ্য নয় । তবে সে বিষয়ে মানুষের পক্ষে আর কি কথা ? শ্রীব্রহ্মা ষাট হাজার বছর তপস্যা করেও ভগবদহ্লাদিনী শক্তি ব্রজগোপিকাগণের চরণের ধূলিকণা মাত্র লাভ করার আকাঙ্ক্ষাও পূরণ করতে সক্ষম হননি । বৈকুন্ঠের লহ্মীদেবী শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলায় প্রবেশ করার সৌভাগ্য পর্যন্ত লাভ করতে পারেননি, তাই তিনি যমুনার অপর পারে কৃষ্ণপাদপদ্ম ধ্যানেই উপবিষ্ট হয়ে থাকলেন । মহাদেব শিব রাসলীলা দর্শনে গিয়েই বঞ্চিত হয়েছিলেন । অতএব যেখানে এইরকম অবস্থা ঘটে, সেই ক্ষেত্রে কি করে মল-মূত্র-কফ-পিত্ত বিশিষ্ট আধিব্যাধিযুক্ত, ধর্মনিষ্ঠাহীন, ব্রতহীন, কামুক লম্পট দুরাচারী, মদ্যমাংস প্রিয়, নেশাসেবী, জড়বুদ্ধিসর্বস্ব এঁচড়ে পাকাদের দল নিজেরাই রাধাকৃষ্ণ সেজে রাসলীলা করতে পারে ? বা রাধাকৃষ্ণ তত্ত্ব সম্বন্ধে বাজে কথা বলতে পারে……
রাধারাণী কি কৃষ্ণের মামী ?
শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে বলা হয়েছে –
কৃষ্ণবাঞ্ছা-পূর্তি হেতু করে আরাধনে ।
অতএব রাধিকা নাম পুরাণে বাখানে ।।
পুরাণে বলা হয়েছে, শ্রীকৃষ্ণের বাম পার্শ্ব থেকে আবির্ভূত হয়ে সহসা তার শ্রীপাদপদ্ম সেবার জন্য যিনি ধাবিত হয়ে পুস্পচয়ন করে শ্রীকৃষ্ণের প্রথম আরাধনার বিধান করলেন তিনি হচ্ছেন রাধা ।
শ্রীমতী রাধারাণী সম্বন্ধে শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী লিখেছেন –
মহাভাবস্বরূপ শ্রীরাধাঠাকুরাণী ।
সর্বগুণখনি কৃষ্ণকান্তা-শিরোমণি ।।
অর্থাৎ, “মহাভাব-স্বরূপিনী শ্রীমতী রাধারাণী হচ্ছেন সমস্ত গুণের আধার এবং শ্রীকৃষ্ণের প্রেয়সীগণের শিরোমণি ।”
গোলকে শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধা নিত্য কান্ত ও কান্তারূপে বিরাজমান । সেই কথা শ্রীব্রহ্মা ব্রহ্মসংহিতায় (৫/৩৭ শ্লোকে) বর্ণনা করেছেন, “পরম আনন্দদায়িনী শ্রীমতী রাধারাণীর সঙ্গে যিনি স্বীয় ধাম গোলকে অবস্থান করেন এবং শ্রীমতী রাধারাণীর অংশ-প্রকাশ চিন্ময় রসের আনন্দে পরিপূর্ণ ব্রজগোপীরা যার নিত্য লীলাসঙ্গিনী, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি ।”
ভগবানের ভক্ত পার্ষদগণ কত সুন্দরভাবেই শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের কথা উল্লেখ করেছেন । কিন্তু জড়বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা সেই সব সুন্দর সরল কথাগুলি জেনেও ‘সাতকান্ড রামায়ণ পড়ে সীতা রামের মাসী’ বলে চিন্তাকরতে থাকেন । জটিল আর কুটিল মানসিকতা সম্পন্ন লোকেরাই রাধারাণীকে কৃষ্ণের মামী বলে ব্যাখ্যা করতেই পারেন । কারণ আপন লাম্পট্য ভাবধারা দিয়ে ভগবানের চরিত্র ব্যাখ্যা করে তারা আমোদ পেতে খুবই আগ্রহী । ষড় গোস্বামীর গ্রন্থ অধ্যয়ন করলে তারা কখনও অনর্থক কথাগুলি বলতে পারেন না । শ্রী রাধারাণী হচ্ছেন কৃষ্ণপ্রিয়া আর শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন রাধানাথ ।
সংগৃহীত : সুশান্ত বন্দ হতে
No comments:
Post a Comment