Sunday, April 03, 2016

প্রতিবেশী প্রতিবেশীতে এতো ঘৃণা কেন?

অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম এই বিষয়টা নিয়ে লিখব, কিন্তু সময় করে উঠতে পারছিলাম না। যাক, আজ T20 ক্রিকেট বিশ্বকাপের সমাপ্তির পর ভাবলাম এ নিয়ে লিখে ফেলি।

গত কয়েক মাস, হয়ত কয়েক বছর ধরে আমরা দেখছি বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশের মানুষের ভারতের বিপক্ষে খেলার সময় একটা গভীর শত্রুতা চলে। ৯০ এর দশকে যখন ভারত-পাকিস্তান খেলায় মানুষ টান টান উত্তেজনা পেত, আজকালকার ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচে তা পাচ্ছে। তার প্রধান কারণ গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেট অনেক উন্নতি লাভ করেছে। ভালো ভালো খেলোয়াড় তৈরি হয়েছে যারা একাই ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য রাখে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের তথা সমর্থকদের মধ্যে এক প্রতিযোগিতায় শূণ্যতা দেখা যায় যখন দলটি নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, শ্রীলংকার মতো দলের বিরুদ্ধে খেলে। এমনকি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয় মাঝে মাঝে বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলাতেও ততটা মরিয়া হয়ে খেলেনা যতটা ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচে খেলে।

এর প্রধান কারণ কি? অনেকেই বলে বিসিসিআই বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাথে জোচ্চুরি করে ও করছে। সম্প্রতি বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে আরাফাত সানি ও তাসকিন আহমেদ নামক বাংলাদেশী বোলাররা সাময়িকভাবে বরখাস্ত হন আইসিসির বোলিং আইন ঠিকমত পালন না করার জন্য। এ নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। আমার উদ্দেশ্য এ নিয়ে কথা বলা নয়। বাংলাদেশের মানুষের বক্তব্য আইসিসি তথা বিসিসিআইই বাংলাদেশকে ভয় পেয়ে এমন করেছে দলটিকে দুর্বল করে দেবার জন্য। এখানে আইসিসিকে বিসিসিআইয়ের সমার্থক বানিয়ে ফেলছে বাংলাদেশীরা যেহেতু কিছু উচ্চপদস্থ বিসিসিআইয়ের কর্তাব্যক্তিরা আইসিসিরও কর্তার আসনে বিরাজিত।

চলুন কিছুটা পেছনে দেখি। ২০০৭ সালের ODI বিশ্বকাপ ফাইনালে শেষ কয়েক ওভার এতটাই আলোকস্বল্পতার মধ্যে খেলা হয়েছে যে বাউন্ডারীর পাশের আয়োজকরা টর্চ, গাইড কুকুর নিয়ে চলাফেরা করছিলো। দর্শকদের টিটকারীর মুখে, কিছু আম্পায়ারের অনিচ্ছা সত্ত্বেও আইসিসি ম্যাচটি চালিয়ে যায় আরো কিছুটা। যদিও তখন অতিরিক্ত দিন রাখার প্রচলন ছিলো, আইসিসি সেটি উপেক্ষা করে ম্যাচটি সম্পূর্ণ ঘোষণা করে। Duckworth-Lewis পদ্ধতি যেখানে বৃষ্টিজনিত ম্যাচে প্রযোজ্য, সেটি ওই ম্যাচে আলোকস্বল্পতার জন্য ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া মুত্তিয়া মুরালিধরনের বোলিং পদ্ধতি নিয়েও তো কম রেষারেষি চলেনি শ্রীলংকা-অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে। এমনকি অবসরের পরে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট তার আত্মজীবনীতে বলেছেনও যে, আইসিসির উচিত ছিলো মুরালিকে বরখাস্ত করা। পাঠকের এক্ষেত্রে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এ নিয়ে যে, আমি কিন্তু বলছি না কার বোলিং অ্যাকশন সঠিক ছিলো বা আছে, আমি দেখাতে চাচ্ছি যে আইসিসিতে দুর্নীতি আগেও ছিলো, এখনো আছে। তাহলে এখন কেন সব দোষারোপ আইসিসিকে না করে বিসিসিআইকে করা হচ্ছে, বিশেষকরে বাংলাদেশী সমর্থকদের পক্ষ থেকে?

আসলে এর মূলে দেখলে আমরা দেখব এই তীব্র পরিমাণ ঘৃণা যা ছোটখাট দেশগুলো তাদের প্রতিবেশীদের উপর করে থাকে। বাংলাদেশীরা যেমনটি ভারতকে ঘৃণা করছে, তেমনি আমেরিকার চারপাশের প্রতিবেশীরাও (মেক্সিকো, দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো, ক্যারিবিয়ান দেশগুলো) শ্যামচাচার দেশকে করে থাকে। কিন্তু কেন? কেন কোনো আপদে-বিপদে আমেরিকা যদিও তার প্রতিবেশীর পাশে এসে দাঁড়ায় (যেমনটি কয়েকবছর আগে হেইতির ভূমিকম্পের পরে করেছিলো) কিন্তু তবুও ঘৃণার রোষে পড়ে? কেনই বা ভারতের কোটি কোটি টাকা বাংলাদেশের পরিকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য জন্য দেবার পরেও বাংলাদেশীরা ভারতকে ঘৃণা করে যায়?

আসলে আমি বিষয়টিকে দেখি কিছুটা অন্যভাবে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান কিংবা মেক্সিকো, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জগুলো ভারত-আমেরিকাকে এদের প্রতিযোগী ভাবে সবকিছুতে। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, ভারত-আমেরিকা উভয়ই কিন্তু বিশ্বের জনসংখ্যার দিক দিয়ে অন্যতম বড় দুইটি দেশ। ফলে স্বাভাবিকভাবে বড় দেশের (আয়তন ও জনসংখ্যা) চাহিদাও বেশী হবে। আর সেই চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে মাঝে মাঝে এসব দেশের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে নিজের অধীনগত মনে করে নানান নীতি বাস্তবায়ন করে। বাস্তবতার ফলশ্রুতিতে কি বাংলাদেশ কিংবা মেক্সিকো যদি ভারত ও আমেরিকার স্থাণে হতো আজকে, তারা কি ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করত? পাঠক একটিবারের জন্য নিজেকে নিরপেক্ষ আসন থেকে সরিয়ে সেইসব দেশের ভূমিকায় ফেলে ভেবে দেখুন। যেইসব পদ্ধতিতে ভারত তার স্বার্থের জন্য বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানকে পিষিয়ে যাচ্ছে, এইসব দেশগুলো যদি এমন বড় আয়তনের, বড় জনসংখ্যার, বড় বাণিজ্যের দেশ হতো, তখন কি ওই একই মানসিকতা কাজ করত? কিংবা মেক্সিকো যদি আমেরিকার মতো বড় আকারের দেশ হতো, তখন মেক্সিকো কি একই রকম চিন্তা করত আমেরিকার প্রতি যেমনটি আজ ছোট দেশ হিসেবে করছে?

এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর মানুষের এমন ঘৃণাকে পুঁজি করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের চরমপন্থী, জিহাদী সংগঠনগুলো তাদের কার্যাবলী চালাতে আরো লোক জোগাড় করতে সমর্থ হয়। কিংবা দারিদ্রকে কাজে লাগিয়ে উন্নত জীবনের আশা জাগিয়ে ড্রাগ কার্টেল গ্রুপগুলো মাদক ও নানান বিষাক্ত সরঞ্জামাদি পাচার করে আমেরিকার মতো দেশে। মধ্যপ্রাচ্যের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোও আমেরিকার বা ভারতের আভ্যন্তরীন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত লোকজনকে তখন কাজে লাগায় সেইসব দেশের ভেতরে সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনা করার জন্য। আর এতে আমার-আপনার একটুখানি ঘৃণা সেইসব বড় দেশের প্রতিই এসব সন্ত্রাসীদের চাঙ্গা করতে ভীষণ ভূমিকা পালন করে।

তাই আমি মনে করি সামনেরবার ভারত-আমেরিকার প্রতি ঘৃণা বর্ষণের পূর্বে একবার ভেবে দেখবেন আপনার বাবার চিকিৎসার জন্য আপনি মাদ্রাজেই যাচ্ছেন চিকিৎসা করাতে কিনা, উচ্চ শিক্ষার জন্য যাচ্ছেন ব্যাঙ্গালোরে কিনা, কিংবা কোরবানীর ঈদে গরু কিনছেন ভারত থেকে আগতগুলোই কিনা। শাকিরা (কলম্বিয়া), নিকি মিনাজ (ত্রিনিদাদ) বা সালমা হায়েকের (মেক্সিকো) মতো সেলিব্রিটিরাই বা কেন আমেরিকায় গেলেন নিজ নিজ পেশায় নাম-খ্যাতির জন্য? যেমনভাবে ঘরের মধ্যে বাক-বিতন্ডা হবার পরেও স্বামী-স্ত্রীতে ঠিকই আবার বনিবনা হতে হয় একটি দীর্ঘ সুখী দাম্পত্যের জন্য, তেমনি প্রতিবেশী-প্রতিবেশীতেও যতই মনোমালিন্য হোক না কেন, পরিশেষে মধুর সম্পর্ক বজায় রাখাটাই শ্রেয় নিজের ও চারপাশের সকলের মঙ্গলের জন্য। আর এর মানে এই নয় যে, নিজের সার্বভৌমত্বকে বিসর্জন দিয়ে এই সম্পর্ককে বজায় রাখতে হবে, কিন্তু সবসময় প্রতিবেশীর প্রতি ঘৃণার ভাবটা নিজের ও অপরের কারও জন্য কাম্য নয়। কারণ কেই বা জানে, হয়ত একসময় মেক্সিকো যদি আমেরিকার মতো স্থাণে পৌঁছায়, কিংবা বাংলাদেশ ভারতের স্থাণে, তখন তাদের নিজেদের ভূমিকাগুলোও যে বদলে উল্টোটি হয়ে যাবে না তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে? To Kill a Mockingbird এর Atticus Finch এর ভাষায় বললে - "you never really know a man until you stood in his shoes and walked around in them".

ভেবে দেখবেন ...

No comments:

Post a Comment