তখন
ক্লাশ থ্রি কিংবা ফোর। বাড়িতে জমা হয়ে থাকা পুরোন সব পত্র-পত্রিকার মধ্যে
থেকে টেনে বের করা কোন এক আনন্দমেলার পাতায় পড়েছিলাম ‘হীরের আংটি।'
শীর্ষেন্দুর গল্প পড়তে শেখা ওই সময় থেকেই। গল্পের এক অদ্ভুতুড়ে মেজাজ
না-পাকা কিশোর মনকে টেনে নিয়ে ফেলত ওই সব আজগুবি চরিতের মধ্যে। শীর্ষেন্দুর
সেই অদ্ভুতুড়ে মেজাজের একটু বাইরে ছিল ‘হীরের আংটি।' এক ধনী পরিবারে হঠাৎ
তৈরী হওয়া এক ক্রাইসিসকে ঘিরে এক গল্প। সেবার গরমের ছুটিতে টিভিতে এক
দুপুরে দেখলাম সেই গল্পটাই ছবি হয়ে এসেছে। ছুটি-ছুটিতে ‘হীরের আংটি’
দেখাবে। সত্যি বলতে গল্প পড়ে যতটা মজা পেয়েছিলাম, সেই মজাটা ছবি দেখে পেলাম
না। ছবির সাথে গল্পের অমিল অনেকটাই। পরিচালকের নাম দেখলাম, ঋতুপর্ণ ঘোষ,
নতুন। একদিন মা আর বাবা আমায় বাড়িতে রেখে ‘বড়দের ছবি’ দেখে এল। ছবির নাম
‘ঊনিশে এপ্রিল।' এরকম তারিখ দিয়ে নাম, কি অদ্ভুত লাগল। মা বলল এত ভালো ছবি
নাকি অনেকদিন পর হল বাংলায়। কি জানি, হবেও বা! তারপর আসতে আসতে বড় হওয়ার
সাথে সাথে খবরের কাগজ, টিভির সাথে কানে আসতে থাকে কত টুকরো খবর। সদ্য টিন
এজার তকমা পাওয়া একটু একটু করে বড় হয়ে ওঠা মন কৌতূহল জাগায় ‘দহন’ ঘিরে। কি
এমন দৃশ্য আছে! সে কথা অনেক বড় হয়ে ওঠে অব্ধিও কৌতূহল হিসাবেই থেকে গেছিল
মনের ভিতর।
এর মধ্যে যখন ক্লাশ এইটে পড়ি বাড়িতে কেব্ল্ লাইন নেওয়া
হল। হঠাতই এক বিকেলে এক নতুন চ্যানেলের (আকাশ বাংলা) উদবোধনী ছবি হিসাবে
দেখানো হল ‘উৎসব।' অপরিণত মনে এটা বড়দের ছবি – এই বোধটা প্রবল হয়ে উঠল।
কিন্তু একটা ভালোলাগা তৈরী হল ছবি ঘিরে।
প্রেসিডেন্সি কলেজে ঢোকার পর
খুব স্বাভাবিক ভাবেই চলচ্চিত্র নিয়ে আগ্রহটা বিস্তৃত হল। অনেক দেশ-বিদেশের
ছবি হাতে এল। রাতের বেলা হেডফোন কানে দিয়ে দেখে ফেললাম ‘অটাম সোনাটা।'
বন্ধু বলল এটাই নাকি ‘ঊনিশে এপ্রিলের’ প্রেরণা। পাড়ার সিডির দোকানে বন্ধুর
মেম্বারশিপ কার্ডে নিয়ে এলাম ‘ঊনিশে এপ্রিল’, ‘রেইন কোট।' সিনেমা দেখা
শিখতে শুরু করেছি ততদিনে। সাংঘাতিক ভালো লাগল ‘ঊনিশে এপ্রিল’এর ডায়লগ,
বারবার ঘুরে ফিরে শুনলাম শুভা মুদ্গলের গলায় ‘রেইন্কোট’এর টাইটেল সং। কি
অসাধারণ সব লিরিক্স! এমন ব্রজবুলি ভাষায় লিখেছেন এই ভদ্রলোক! কি আশ্চর্য
প্রতিভা তাঁর! এর অনেকদিন পরে আই আই টিতে এক রাতের আড্ডায় আমার কাছে
পরিস্কার হয়েছে ‘ঊনিশে এপ্রিল’এর নামকরণের কারণ। ভদ্রলোকের রবীন্দ্রজ্ঞান
ততদিনে আমার শ্রদ্ধার উদ্রেক করেছে। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর তারিখ ঊনিশে
এপ্রিল ছিল, এটা জানার পর থেকে সেই শ্রদ্ধার পরিমান আরো অনেকখানি বেড়ে গেল।
কলেজে ফেরতা এক বৃষ্টির বিকেলে ‘পূরবী’ হলে দেখলাম চলছে সদ্য রিলিজ
হওয়া ‘দোসর।' একলা টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম। প্রসেনজিতের অভিনয় দেখে মুগ্ধ
হলাম। সাদা-কালোতে ফোটোগ্রাফি, সংলাপ সব মুগ্ধ করে দিল সদ্য বড়দের সিনেমা
দেখার অনুমতি পাওয়া মনকে। পাড়ার সিডির দোকান থেকে সিডি ভাড়া করে দেখে
ফেললাম ‘বাড়িওয়ালি’, ‘শুভ মহরত’, ‘অন্তরমহল।' শুধু মুগ্ধ হয়ে শুনেছি সংলাপ,
রবীন্দ্রসংগীতের আশ্চর্য ব্যবহার। দিনের পর দিন গুন্গুনিয়েছি ‘চোখের
বালি’র অসাধারণ মিউজিক।
বি এস সি পাশ করার পর প্রথম বার ডেটে যাব সদ্য
প্রেমিকার সাথে। অনেক ভাবনার পর গন্তব্য ঠিক হল নন্দন। চলছে ‘খেলা।'
ঋতুপর্ণ ঘোষের। তাঁর অন্যান্য ছবির তুলনায় অনেক দুর্বল হলেও আমার জীবনের
একটা মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিল ‘খেলা’, এক সাথে হাতে হাতে হাত ছুঁইয়ে দিয়েছিল।
এরপর অনেকছবি বারবার দেখেছি। ফিরে দেখেছি ‘হীরের আংটি।' মোহিত হয়ে গেছি
ডায়ালগ শুনে, মিউজিক শুনে। ছোটবেলার নির্বোধ না-ভালোলাগাটাকে করুণা করেছি
মনে মনে।
এইসব ভালোলাগা গুলো জীবনের সাথে জড়িয়ে গিয়ে ঋতুপর্ণকে আমার
জীবনের একটা অংশ করে দিয়েছিল নিজের অজান্তে। প্রেসিডেন্সির বারান্দায়
প্রথমবার সামনা-সামনি দেখে কোন কথা বলার সাহস না দেখিয়ে চুপচাপ বাড়িয়ে
দিয়েছিলাম অটোগ্রাফ খাতা। আমার সিনেমা প্রীতির অংশ হিসাবে একবার পরিচালক
হওয়ার ভূত ঘাড়ে নিয়ে দেখা করেছিলাম ‘অনিন্দ্য’দার সাথে। প্রতিদিন কাগজের
অফিসে কথার ফাঁকে আমায় জিজ্ঞেস করেছিল, “পড়াশোনাটা আগে শেষ করে নেবে, তারপর
এদিকে আসবে, নাকি, এখনই করতে চাও? তাহলে ঋতুদার সাথে অবসার্ভিং ডিরেক্টরের
কাজ করতে পারো। আমি কথা বলে দেখতে পারি।“ সেদিন এক অনিশ্চয়তায় দুলে
পড়াশোনাটাকেই বেছে নিয়ে বলেছিলাম, “ঠিক আছে, আগে মাস্টার্স কমপ্লিট করি,
তারপর।“ জীবনের একএকটা ইচ্ছে থাকে - আকাশকুসুম। খুব ইচ্ছে ছিল ঋতুপর্ণ
ঘোষের সেটে থাকব, চুপচাপ দেখব কিভাবে ভদ্রলোক এমন সব অসাধারণ সৃষ্টি করেন,
কিভাবে লেখেন এমন সব সংলাপ! সে আর এ জীবনে হলনা। সকালের মুখ ভার করা আকাশের
দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে এমন কত কথা মনে এল। মানুষের সাথে আত্মার সম্বন্ধ না
থাকলেও যে প্রাণের সম্বন্ধ গড়ে তোলা যায়, টের পাচ্ছিলাম। আমার মত এক
নিতান্ত সাধারণ সিনেমাপ্রেমী যুবকের কাছে তাঁর ছবি যে কতভাবে আসতে পারে,
ভালোবাসাতে পারে, জন্ম দিতে পারে নতুন বোধের তা অবর্ণনীয়। অনেক চ্যাট শোতে
তাঁর মুখের রবীন্দ্রকথা শুনে মনে মনে টুকে রেখেছি, তাঁর ছবির আবহসংগীত
গুনগুন করেছি, অনুপ্রেরণা পেয়েছি নতুন ভাবে রবীন্দ্রনাথ পড়ার। এই সব শেখা
অপূর্ণ থেকে গেল। এক আকাশ কালো মেঘ সাথে দিয়ে কালপারের অজানায় সাঁতরালেন
তিনি। আমাদের ভাঙা নৌকা আধ ডোবা হয়ে থেকে গেল ঘাটের কোণে। এক বুক ব্যাথা আর
অপরিপূর্ণ হৃদয়ে বিদায় ঋতুপর্ণ।
(By:Saikat Bhattacharya)