গেল বছরটি ২০০৯ এ (যদিও এখনো আমার ঘড়িতে ৩১শে ডিসেম্বর, ২০০৯ প্রায় বিকেল ৫টা বাজে) আমার জন্য ছিল নানা ঘটনায় মেশানো। ২০০৩ সালে আমেরিকা আসার পরে এই বছরটিই ছিল আমার/আমাদের পরিবারের সবচেয়ে ঘটনাবহুল বছর।
জানুয়ারী মাসেই আমি ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষায় পাস করি। যদিও গতবছর ২০০৮ এ একবার দিয়েছিলাম, কিন্তু সেবার পাস না করায় প্রায় ছ'মাস পরে আবার দিয়ে পাস করে আসি। উল্লেখ্য, আমার বাবাও বছরের মাঝামাঝি সময়ে পাস করেন। যদিও ২০০৩ সালে এসেছি বিদেশে, তবুও গাড়ির প্রতি একটু দুর্বল ভাব ছিল বাবার। তাই দিতে দিতে দেরী হয়ে গিয়েছিল। আমার মা অবশ্য গত ২০০৭ এই পাস করে লাইসেন্স করে ফেলেছিলেন।
শুরুটা শুভ দিয়ে শুরু হয়ে আরো শুভ হয়। এর কারণ হলো ফেব্রুয়ারী মাসেই আমার বাবা-মা আমেরিকার নাগরিকত্ব পান। ডিভি লটারীধারীরা ৫ বছর আমেরিকা থাকার পরেই নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারেন। তাই ২০০৩ সালে আসলেই ২০০৮ এ এ্যাপ্লিকেশন করা হয়। সেটা প্রসেসিং হতে হতে নাগরিকত্বের পরীক্ষা পড়ে ফেব্রুয়ারীতে। সে মাসেই উনারা দু'জন পাস করে নাগরিকত্ব পেয়ে যান।
এরপর আমাদেরও ডাক পড়ে কয়েক মাস পড়ে (প্রায় গ্রীষ্মের ছুটির দিকে)। আমাদের দু'ভাইয়েরও বিনা ঝামেলায় নাগরিকত্ব হয়ে যায়। সার্টিফিকেট বয়স আমার তখনও ১৮ হয়নি বলে আমার জন্য আলাদা এ্যাপ্লিকেশন করতে হয়নি।
যা হোক, শুভয় শুভয় চলতে গিয়ে এলো গ্রীষ্মের ছুটি আমার (প্রায় মার্চের মধ্যখান সময় থেকে)। প্রথম বছর শেষ করলাম ভার্সিটি লাইফের। যেহেতু অর্থনৈতিক একটা মন্দা চলছিল আমেরিকায়, বাবা মনস্থির করলেন এ বছরই সম্ভব হলে একটা বাড়ি করতে হবে। মর্টগেজ রেট তুলনামূলক কম (অন্যান্য যেকোনো বছরের চেয়ে)। তাছাড়া, ওবামা সরকার নতুন বাড়ির মালিকদের এ বছর আলাদা একটা বোনাস জাতীয় পয়সা দেবেন (শুনেছি $৮০০০)। তাই সবকিছু বিবেচনা করে শুরু হলো, বাড়ি খোঁজা।
প্রথমদিকে ফোরক্লোজড বাড়ি, পরে শর্ট সেলে বা যেকোনো পন্থায় কম দামের ১-পরিবারের জন্য বাড়ি খুঁজতে শুরু করলাম। বেশীরভাগই কম দামেরগুলো খুঁজে গিয়ে পেলাম তুলনামূলক খারাপ এলাকায়। যেহেতু মা'র কাজ সকালে ও বাবার কাজ রাতে, তাই এমন এলাকা আমাদের জন্য নয়।
অবশেষে প্রায় ৩-৪ মাস খোঁজা, প্রসেসিং ইত্যাদি নানা ঝামেলা উপরিয়ে শেষে ৩১শে অগাস্ট ক্লোজিং করা হয় জ্যামাইকা অঞ্চলের একটি নতুন বাড়ির। মালিকানা আমার বাবা-মা একা নন। কারণ তাদের দু'জনের বার্ষিক পারিশ্রমিক তাদেরকে ব্যাংক লোন থেকে বিমুখ করে দেয়। ফলে আমার মাসি-মেশোমশায় এর সাথে যৌথভাবে দুই পরিবারের জন্য উপযোগী ৩-বেডরুম বিশিষ্ট (দুই তালা; প্রতিটি তালায় ৩-বেডরুম) বাড়ি ক্রয় করা হয়। এই প্রসেসিং এর মাঝে কত যে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে আমাকে ও আমার বাবাকে এ শুধুমাত্র ঈশ্বরই সাক্ষী আছেন।
যা হোক, শেষ পর্যন্ত ভগবানের কল্যাণে মোটামুটি ভালো দরে ও ভালো মর্টগেজ রেটে ৩০-বছরের লোন দিয়ে ব্যাংক স্বীকৃত হয় বাড়ি ক্রয় হয়।
কিন্তু এর পরপরই বাবার কাজ চলে যায়। যদিও ইতিমধ্যে উনার আগের ৩ বছর ধরের কাজটা কানাডিয়ান মালিকের কাছে গুটিয়ে দিয়ে দেউলিয়া হয়ে যায়। তারপর উনাদেরকে ম্যানহাটনে কাজ করতে হয় কিছু মাস। কিন্তু এরই মাঝে সে কাজ থেকেই বাবাকে ছাঁটাই করা হয়।
নতুন বাড়ি কিনে এমন এক ধাক্কা (যেখানে মাসে মাসে গুণে গুণে ব্যাংককে মর্টগেজ দিতে হবে) সেখানে কাজ হারানো কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো। যা হোক, কয়েক সপ্তাহ কাজ হারিয়ে ঘরে বসে থেকে বাবা দেখতে দেখতে বাড়ির কাছেই একটা নতুন জায়গায় কাজ নেন। কিন্তু সেখানে আবার সপ্তাহের সাতদিনই কাজ করতে হবে। একে তো তিনি ডায়াবেটিসের রোগী। প্রতিদিনই ঔষধ সেবন করছেন ডায়াবেটিসের জন্য, তার উপর সাতদিন ৯-১০ ঘন্টা রাতের কাজ একেবারে অসহনীয়। কিন্তু কিছুই করার নেই। কাজও করতে হবে। বাড়িটাকেও ধরে রাখতে হবে। কিছু সপ্তাহ আগে থেকে আবার হাত দুটো নাকি উনার অবশ হয়ে আসছে বলে বলছেন। হাসপাতালে নিয়ে গেলেও তেমন উপকার হলো না।
এই ফাঁকে আমার দ্বিতীয় বছরের প্রথম সেমিস্টার শেষ হয়ে গেল। ভার্সিটিতে যে ওয়ার্ক-স্টাডিতে কাজ করতাম আগের স্কুলবছর এবার নতুন জায়গায় শুরু করতে হয়েছে। আমার এই পার্ট-টাইম কাজটুকু পরিবারের জন্য একটা আশার আলোর মতো। যা হোক, সেমিস্টারের রেজাল্ট মোটামুটি হয়েছে। ততটা আশাপ্রদ হয়নি যতটা আমি চেয়েছিলাম।
তাছাড়া, এ বছরই আমি সার্টিফিকেট হিসেবে ১৮-তে পা দেই। যদিও মূল বয়স প্রায় ২০ এর মতো (কুষ্ঠী অনুযায়ী)।
এই করতে করতেই বছর প্রায় শেষ হয়ে এলো। এবার নতুন বছরের দিকে তাকানো এবং এই আশায় বুক বাঁধা যেন নতুন বছর আরো ভালো যায় গেল বছরের চেয়ে।