আজ প্রায় বছর ব্যাপী পরিচালিত Star Plus-এর "মহাভারত" সমাপ্ত হলো। সিদ্ধার্থ কুমারের পরিচালনায় যদিও এই আধুনিক "মহাভারত" একতা কাপুরের "কাহানি হামারী মহাভারত কি" থেকে বহুলাংশে ভালোভাবে বিভিন্ন চরিত্র, ঘটনাসমূহ ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে, তবুও সর্বাঙ্গিকভাবে বললে বলদেব রাজ চোপড়া'র ৯০-এর দশকের "মহাভারত" অনেকটাই এগিয়ে থাকবে, আমার দৃষ্টিতে। কিন্তু বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট চিন্তা করলে সিদ্ধার্থ কুমারের তৈরি এই "মহাভারত" তরুণ প্রজন্মকে অনেকাংশেই নাড়া দিয়েছে যা আমার ধারণা চোপড়া বাবুর "মহাভারত" ততটা করতে পারেনি।
আমি চোপড়ার "মহাভারত" ৩-৪বার পুরোটা দেখেছি। যতবারই দেখেছি ততবারই নতুন করে কোনো না কোনো ছোটখাট বিষয় হলেও নবীন ভাবে আবিষ্কার করেছি যা আগেরবার পারিনি। সেবারের "মহাভারতে" কথক ছিলেন 'সময়' যেটা প্রথম প্রথম কথাগুলো শুনতে ভালোই লাগতো, পরে একসময় fast forward করে মূল ঘটনায় চলে যেতাম। কিন্তু এবারের "মহাভারতে" শ্রীকৃষ্ণকে কথক বানিয়ে পরিচালক দারুণ একটা কাজ করেছেন বলতে হবে। বিশেষকরে প্রথম দিকের পর্বগুলোতে প্রায় প্রতিটি পর্বে শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষাগুলো সত্যিই শিহরিত করেছে। যদিও আমরা প্রায় প্রত্যেকেই এখনকার সময়ে শ্রীমদভগবদগীতা পাঠ করে থাকি, কিন্তু কৃষ্ণের শিক্ষাগুলো যেন নতুনভাবে আমার মতো হাজারও যুবকের প্রাণে স্পন্দন জাগিয়েছে - সেরকমই বোধ করেছি। গীতা পড়ে যতটা না বোঝা যায়, কৃষ্ণের সেই ছোট ছোট শিক্ষাগুলোতে বাস্তব জীবনের সাথে উদাহরণ এনে বোঝানোর বিষয়গুলো আমি নিশ্চিত আমার মতো আরো অনেককেই নাড়া দিয়েছে। তার সাথে সাথে নেপথ্যের সুরগুলো, গানগুলো আরো বিশেষ করে যেন হৃদয়ে লেগেছে। আমি নিশ্চিত আমার মতো অনেকেই হয়ত এগুলো থেকে কোনো না কোনো পছন্দেরটা নিজেদের ফোনের রিংটোন হিসেবে ব্যবহার করছে ও করবে।
শ্রীকৃষ্ণের প্রসঙ্গক্রমে বলতে গেলে অবশ্যই মানতে হবে সৌরভ রাজ জৈন এই বিষ্ণু অবতারকে বেশ দারুণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যেমন আগেরবারের কৃষ্ণ চরিত্রে অভিনয় করা নীতিশ ভরদ্বাজ চোপড়ার করা "মহাভারত" ও "বিষ্ণুপুরাণে" অভিনয়ের পরে ধ্যানে বসলেই কৃষ্ণরূপে তার চেহারাটাই ভাসতো, আজকের সময়কার এই "মহাভারত" করার পরে, আমার মতন অনেকেই কৃষ্ণ কল্পনায় সৌরভ রাজ জৈনের চেহারাকেই ভাববেন। এটাই একজন অভিনেতার জীবনকালের সবচেয়ে সেরা প্রাপ্তি। এই দুই কৃষ্ণ/বিষ্ণু অবতারের ভূমিকায় অভিনয় করা ব্যক্তিরা ব্যক্তিগত জীবনে কতটা ধর্ম-কর্ম করেন বা করবেন জানিনা, তবে এদের চরিত্রায়নের ফলে ঈশ্বরকেই যেন কল্পনা করা হবে নানা ভক্তের দ্বারা - এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
অন্যান্য যেসব চরিত্রে অন্যান্য অভিনেতা-অভিনেত্রী অভিনয় করেছেন, কারোরই চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলাতে কমতি ছিলো না। বিশেষ করে কৌরবদের মামা শকুনির চরিত্রে প্রণীত ভট্টের অভিনয় কোনো অংশেই গুফী পাইন্টালের অভিনয়ের থেকে কম ছিলো না। আর তাছাড়া মূল গ্রন্থের সাথে সামঞ্জস্য রেখে যেরকম করে ল্যাংড়া হয়ে চলাফেরা, এক চোখ বন্ধ রেখে কথা বলা - এসব বিষয়গুলো এতো স্বাভাবিক ভাবে করেছে, যেন মনেই হয়নি তিনি শকুনি নন।
অনেকেই বর্তমান এই মহাভারতে অর্জুনকে মূল মহাকাব্যের নায়কের ন্যায় ভূমিকায় ভূষিত করে দেখানোর জন্য সমালোচনা করেছেন। হ্যাঁ, এটা অবশ্যই ঠিক যে মহাভারতের কোনো মধ্যমণি বা নায়ক নেই। আর যদি কেউ থেকে থাকে, তা নিঃসন্দেহে শ্রীকৃষ্ণ নিজে। আমার দৃষ্টিতে শ্রীকৃষ্ণকেই সেরকমভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সিদ্ধার আনন্দ কুমারের এই "মহাভারতে"।
পরবর্তী সুপারিশস্বরুপ এই "মহাভারতের" তৈরিকারকদের কাছে আমার মতো অনেক ভক্তই লেখালেখি করেছেন যেন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরেই যেন শেষ করে না দেওয়া হয় এটি। কিন্তু প্রথমে যেই ২০০ পর্বের বাজেটি মাথায় রেখে কাজ শুরু করেছিল এই সিদ্ধার্থ কুমার ও তার টিম, সেখানে ২৬৭টি পর্বতে শেষ করা কম কষ্টের বিষয় না। সেদিক থেকে চিন্তা করলে অবশ্যই এই তৈরিকারকদের সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতেই হবে। হ্যাঁ, আরো পরবর্তী ঘটনাগুলো দেখালে আমার মতো নতুন প্রজন্মের অনেকেরই ভালো লাগতো, নতুন কিছু শেখা যেতো - কিন্তু সব ভালোর তো একটা শেষ আছে, যেমন সব খারাপের অন্ত আছে। একটা সময় তখন সেটারও আসতো যখন সেটি শেষ হতো। বরং নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে সিংহাসনে বসিয়ে, ন্যায়ের শাসন পুনঃস্থাপনা করে, অধর্মকে ধ্বংস করে ধর্মের প্রতিষ্ঠা করে এই মহাকাব্যের ইতি টানা কোনো অংশেই বেমানান হয়নি। তাছাড়া, কালকে শ্রীকৃষ্ণের ৫২৪০তম জন্মবার্ষিকীতে (জন্মাষ্টমী) আমাদের মধ্যে কৃষ্ণের বাণী পরিস্ফুটিত হবে - সেই কামনা সিদ্ধার্থ কুমারের ছিলো কিনা জানিনা, কিন্তু তিনি যা করেন ভালোর জন্যই করেন, সেটাই আবার বুঝিয়ে দিলেন। মাঝে শুধু আমার মতো কিছু তরুণ-যুবকদের মাঝে যে নতুন করে সনাতন ধর্ম সম্পর্কে জানার স্পৃহা জাগিয়ে দিয়ে গেলো সেটার অভাব যে অনুভব করব, সে নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই। আমার মতো অনেকেরই হয়ত সারা দিনটা পার করে ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহে ঘরে বসে রাতের বেলা এই মহাকাব্য দর্শনের সেই নিত্যকর্ম আর করা হবে না অন্য কোনো কিছু দিয়ে। তবুও বলব, ধন্যবাদ সকল কলাকুশলী, তৈরিকারকগণ, প্রযোজক, পরিচালক সকলকে। আপনারা নতুন প্রজন্মের সনাতনী সমাজকে আবার ধর্মচর্চায় উদ্বুদ্ধ করেছেন নিঃসন্দেহে। আপনাদের প্রাথমিক প্রচেষ্টায় এটি ছিলো কিনা জানি না, তবুও বলবো, 'তিনি যা করেন, ভালোর জন্যই করেন'।