Showing posts with label writing. Show all posts
Showing posts with label writing. Show all posts
Thursday, April 07, 2016
Thursday, March 17, 2016
একটি ছোট গল্প
ভোম্বল ও বোম্বল নামে দুই ভাই ছিলো। একই মায়ের পেটের সন্তান হলেও দু'জনের মধ্যে অনেক তফাত ছিলো। ভোম্বল পড়াশোনায় ভালো ছিলো বলে ডাক্তারি পাস করে দেশের সুনামখ্যাত ডাক্তার হয়ে যায়। আর পড়াশোনা তো দূরের কথা, আড্ডা-ফুর্তিতে মেতে থাকতো বিধায় বোম্বল শেষমেষ দিনমজুরের কাজ করতে শুরু করে। ছোটবেলা থেকেই ওদের বাবা-মা ওদের ভেতরে দায়িত্বজ্ঞানের ভিন্নতা দেখে দু’জনকে কিছুটা দুই নজরে দেখতো। আর তাই নিজের সামর্থ্যে কিছু করার ক্ষমতা দেখার উদ্দেশ্যে বাপ-দাদার সকল জমি-জমা বেচে, একটা ১০ কাঠা খালি জমি দুই ভাইকে সমান ভাগে বিভক্ত করে দেয়। যে যার সামর্থ্যে বাড়ি-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি সেখানে নির্মাণ করবে - সেই ভাবনা থেকেই এটি করা।
দিনের পর দিন ওদের ভেতর দূরত্ব আরও বাড়তেই থাকে। কালের বিবর্তনে ওদের বিয়ে-শাদী হয়, সংসার হয়। দু'জনেরই দুটি করে সন্তান হয়: ভোম্বলের ট্যানা-ট্যানি আর বোম্বলের ট্যাপা-ট্যাপি। ভোম্বল নিজের ৫ কাঠা জমিতে বাড়ি ও ডাক্তারির চেম্বার বসায়। আর বোম্বল ওর ৫ কাঠা জমির এক কোণে কোনোমতে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই করে। দিনমজুর হলে যা হয়। অভাবে স্বভাব নষ্ট। প্রায় প্রতিদিনই মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ঘরে ফেরে সংসারের দুঃখ ভুলে থাকতে। কিন্তু আবার যখন সুচেতন থাকে তখন এমনই ফুরফুরে থাকে যে নিজের ছোটবেলা থেকে পোষা বিড়ালগুলোকে আদর করে, খাবার খাওয়ায়, যত্ন নেয়।
ভোম্বল কিন্তু কখনোই বোম্বলকে দূরে সরাতে চায়নি। এমনকি প্রায় সময়ই বোম্বলের বৌকে বলে ওদের পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভোম্বলের বাড়িতে চলে আসতে। যেহেতু বোম্বল গত প্রায় বছর পাঁচ-সাতেক ধরে ভোম্বলের সাথে একেবারেই কথা বলে না, ফলে বেচারা ভোম্বল বোম্বলের বৌকেই এসব বলে। শুধু তাই নয়, এমনকি কোনো উৎসবে, পহেলা বৈশাখ, ঈদ, দুর্গাপূজা, বড়দিন - এসবের সময় ভালো খাবারাদি রান্না হয় বলে ভোম্বল প্রতিবারই বোম্বলের পরিবারকে নিমন্ত্রণ করে। কিন্তু বোম্বল বাদে ওর ঘরের সবাই আসে। বোম্বলের ছেলেমেয়েরা সচরাচর এমন ভালো খাবারাদি খেতে পারে না সংসারের নানা টানাপোড়েনের জন্য। ভোম্বল চায় না ওদের ভাইয়েদের মধ্যকার ভেদাভেদ ওদের সন্তানরাও বজায় রাখুক। তাই দুই ভাইয়ের সন্তানদের মধ্যে অবাধ বিচরণ, সখ্যভাব বজায় রাখার সর্বদা চেষ্টা করে ভোম্বল। কিন্তু এটা একদমই সহ্য করতে পারে না বোম্বল। তাই এইসব উৎসবের দিনে ঘরেই আর ফেরে না বোম্বল নিজের বৌ-বাচ্চাদের প্রতি রাগ করে। যেহেতু ও এমনিতেই একটু রক্ত গরমের মানুষ তাই বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর কোনো বড় অভিভাবক কাউকে মনে করে না বোম্বল। তাই কেউ সাহস করে ওকে বোঝানোরও চেষ্টা করে না।
এছাড়াও যেহেতু ভোম্বলের বাড়িতে অনেক কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, স্মার্টফোন আছে, ফলে যেকোনো সময় ট্যাপা-ট্যাপির জন্য এসব ব্যবহারে 'দরজা খোলা' বলে দিয়েছে ভোম্বল। ফলে যখনই স্কুলে কোনো প্রজেক্টের সাহায্য লাগে, তখন ট্যানা-ট্যানির কাছে এসে সাহায্য নেয় ট্যাপা-ট্যাপি। ভোম্বলের কল্যাণেই বোম্বলের ছেলেমেয়েগুলো ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলে পড়তে পাচ্ছে। এটিও একদম সহ্য করতে পারে না বোম্বল। ওর ভাবনা এইসব করে ভোম্বল বোম্বলের সন্তানদেরকে কিনতে চাইছে। যদিও এমন কোনো ইচ্ছা বা অভিপ্রায় একদমই নেই ভোম্বলের। কিন্তু বোম্বল নিজের সামর্থ্যে যা আছে, তাই খাওয়াতে চায়, পড়াতে চায় নিজ সন্তানদের।
এরপর কোনো অসুখ, রোগে পড়লে নির্দ্বিধায় বোম্বলের ছেলেমেয়েরা ভোম্বলের চেম্বারে কিংবা বাড়িতে এসে পড়ে। ভোম্বলের এমনই নীতি। ওর কথা যদি আমার সন্তানরা পরিবারের ডাক্তারের কাছে যেতে পারে সময়ে-অসময়ে, তবে আমার ভাইয়ের সন্তানেরা পারবে না কেন? আমি কি ওদের জ্যেঠু না? আর চিকিৎসা সুবিধা মানে তো আর ছোটখাট বিষয় না। একবার বোম্বলের ছেলের কঠিন জন্ডিস হয়েছিলো। শহরে গিয়ে পর্যন্ত উন্নতমানের চিকিৎসা সুবিধা পাইয়ে দিতে, পর্যাপ্ত খরচ করতে দ্বিধাবোধ করেনি ভোম্বল। ওর কথা হলো, ওদের বাবার সামর্থ্য না হলে কি হলো, জ্যেঠুর তো আছে। ছেলেমেয়েগুলো তো কোনো দোষ করেনি। ওরা কেন ভাই-ভাইয়ের দ্বন্দ্বে ভুগবে।
আর বিনোদনের কথা তো বাদই দিলাম। যখনই নতুন কোনো ছায়াছবি বা টিভি শো ট্যানা-ট্যানি দেখতে শুরু করে, ট্যাপা-ট্যাপিকে ডেকে আনতে কখনোই ভুল করে না। এমনকি মাঝে-মধ্যে ট্যাপা-ট্যাপির মধ্যে সিনেমা বা টিভি সিরিয়ালের প্রতি আসক্তি ট্যানা-ট্যানির চেয়েও বেশী দেখা যায়।
মাঝে মাঝে বোম্বল এমন মাতাল হয়ে ঘরে ফেরে যে ওর বৌ-বাচ্চা তো ভয়ে ভীতসন্তস্ত্র হয়ে ঘরের এক কোণে লুকিয়ে থাকে, এমনকি ঘরের বিড়ালগুলোও পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় ভোম্বলের বাড়িতে। পরের দিন সকালে ঠিকই আবার ফেরে বোম্বলের ঘরে। যদিও ভোম্বল কখনোই ওদেরকে তাড়িয়ে দেয় না বা ওদের উপর বিরক্তি প্রকাশ করে না। কিন্তু তবুও এতদিনের অভ্যাস বিড়ালগুলোও ভুলতে পারে না। কিন্তু ওদের প্রভুর মাতলামির রাতগুলোতে প্রভুর চেয়ে প্রভুর বড় ভাইকে ওদের বিশ্বাসটা বেশী।
আসলে এই ভাইয়ে ভাইয়ে পার্থক্য শুরু হয়েছিলো ওদের ছোটবেলার সময় থেকে। বোম্বলের এক শৈশবের বন্ধু ছিলো পোম্বল। দু’জনের মাঝে সখ্যভাব এমনটাই ছিলো যে, সেই ছোটকাল থেকেই বোম্বল বন্ধুকে বেশী বিশ্বাস করত ভোম্বলের চেয়ে। যদিও পোম্বল সবসময়ই ক্রিকেট ব্যাট থেকে শুরু করে নানান কিছুই বোম্বলের থেকে নিয়ে যেত। কোনো কোনো সময় বোম্বল প্রতিবাদ করে সেটা চেয়ে নিতো, কখনো কখনো ভুলেই যেত। বন্ধুত্বের খাতিরে বন্ধুকে ক্ষমা করে দিতো। কিন্তু একবার পোম্বল বোম্বলের নতুন জুতা নিয়ে গিয়ে পরে হারিয়ে ফেলে। বোম্বল যখন চাপ দিলো বন্ধুকে জুতা ফেরত দিতে পোম্বল তখন ওর বাবার ঘরে তৈরি একখানা ছেড়াফেরা জুতা দিয়ে সান্ত্ব করার চেষ্টা করে। দু’জনের মধ্যে রেষারেষি এমন পর্যায়ে ঠেকে যে দু’জনে দু’জনের মুখ দেখলেও ঘুরে ফেলত সাথে সাথে।
এরই মাঝে একবার পথে যাবার সময় পোম্বল বোম্বলকে ‘ভীতু’ ‘কাপুরুষ’ বলে আখ্যা দেয় যখন বোম্বল ভোম্বলের সাথে একসাথে যাচ্ছিলো একই ছাতার নিচে করে বৃষ্টির দিনে। এমন কথায় ভীষণ ক্ষীপ্ত হয়ে বোম্বল পোম্বলের সাথে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে। দুই বন্ধুর হাতাহাতি থামাতে ভোম্বল হস্তক্ষেপ করে। এমনকি পোম্বলকে চড় থাপ্পর দিয়ে দূর করে দেবার পরে শান্ত হয় ভোম্বল। ভাইয়ের প্রতি আঘাত ও একদমই সহ্য করতে পারত না। কিন্তু কী কারণে যে সেদিন থেকে বোম্বল ভোম্বলের সাথে আর কথা বলে না তা কেবল বোম্বলই জানে। ভোম্বলের ধারণা সেদিন দুই বন্ধুর যুদ্ধে ওর সহায়তা বোধহয় পছন্দ করেনি বোম্বল। নানান সময়ে এ নিয়ে কথা বলার চেষ্টাও করেছে ভোম্বল, কিন্তু বোম্বল একরোখা। এরপর দিনের দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর দু’জনের মধ্যে দূরত্ব শুধু বেড়েছেই। আর পরবর্তীতে সংসারাদি, সন্তানাদি হবার পরে বোম্বল তো ভোম্বলকে একদম সহ্যই করতে পারে না। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সকলের প্রিয় পাত্র হিসেবে সমাদ্রিত হয়েছে ভোম্বল। স্কুলে-কলেজে, সাংস্কৃতিক আয়োজনে, খেলাধূলায় সকল কিছুতেই সবসময় ভোম্বল বোম্বলের চেয়ে এগিয়ে ছিলো অনেকাংশে। আর এসব শুধু অনুঘটকের মতো কাজ করেছে দুই ভাইয়ের দূরত্বকে বাড়িয়ে দিতে।
এখন পাঠকের কাছে প্রশ্ন, বোম্বল কি ভুল করেছে এতো বছর ধরে ভাইকে দূরে ঠেলে দিয়ে? নিজের আত্মসম্মান বোধকে মাথায় রেখে কখনো বড় ভাইয়ের দ্বারস্থ না হওয়াটা কি ঠিক ছিলো বোম্বলের? নাকি ভোম্বল ভুল করেছিলো অপরের হাতে ভাইয়ের মার খাওয়া দেখে ভাইকে রক্ষা করতে নিজে উদ্যত হয়ে? ভোম্বল কি ভুল করেছে ট্যাপা-ট্যাপির জন্য নানান সুবিধাগুলো এনে দিয়ে? বড় ভাইয়ের দায়িত্ববোধ কখনো কি ছোট ভাইয়ের আত্মসম্মানে বাধা হতে পারে? নাকি প্রত্যেক ব্যক্তির আত্মসম্মানবোধ বড় অপরের দায়িত্বজ্ঞানের চেয়ে? যারা বড় ভাই-বোন আছেন তারা নিজেকে নিজে প্রশ্ন করবেন তো এগুলো, কি উত্তর পান? কিংবা ছোট ভাই-বোনই বা যারা আছেন, তারা কি উত্তর পান? কারো ভালো চেয়ে সহায়তা করা কি মানব ধর্মের মধ্যে পড়ে না? নাকি যতো বাধা-বিপত্তিই আসুক না কেন, প্রত্যেকের আত্মমর্যাদা কখনোই হারানো উচিত নয়? স্বয়ং বিচার করুন ...
Subscribe to:
Posts (Atom)